অন্যান্য কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ

সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ:

  • ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী, ফকির ও কৃষিজীবীরা প্রথম প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ফকিররা অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী।
  • ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত চলা এই সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল কোম্পানির পরিবর্তিত শােষণমূলক নীতি পদ্ধতি ও কোম্পানির দেশীয় ইজারাদারদের জুলুম ও অত্যাচার।
  • এরা অনেকেই রেশম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং কোম্পানির কর্মচারীর তাদের কাছ থেকে কাচামাল হিসেবে রেশম জোরপূর্বক আদায় করত। এছাড়া তীৰ্থকর আরােপণ ও পীরস্থানে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানারূপ বাধানিষেধ সন্ন্যাসী ও ফকিরদের রুষ্ট করেছিল।
  • বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, ফকির মজনু শাহ, চিরাগ আলি, মুসা শাহ প্রমুখ।
  • বিদ্রোহের প্রসার ঘটেছিল মালদা, দিনাজপুর, কুচবিহার সহ অধুনা বাংলাদেশের রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে।
  • সশস্ত্র প্রতিরােধ বাহিনী গঠন করে বিদ্রোহীরা কোম্পানির কুঠি, নীলকুঠি, রাজস্ব দপ্তর ও বাণিজ্য চৌকি, জমিদারদের বাড়ি আক্রমণ করেছিল।
  • এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ফকির মজনু শাহ কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে বগুড়াতে আহত হন ও পরে বিহারে আত্মগােপনকালে মারা যান।
  • বঙ্কিমচন্দ্র তার আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের একটি রূপরেখা অঙ্কন করে গেছেন।

দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ ১৮৭৫ :

  • মহাজনদের শােষণ , কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ , উচ্চ রাজস্ব হার আরােপসহ বিভিন্ন কারণে দাক্ষিণাত্যের পুনা ও আহম্মদনগরে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিল তা দাক্ষিণাত্য কৃষক বিদ্রোহ নামে পরিচিত ।
  • কোম্পানি ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি আয় বাড়ানাের লক্ষ্যে দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে । রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকা মােড়ল অর্থাৎ প্যাটেলেরা কৃষকদের নানাভাবে অত্যাচার করত ।
  • মহারাষ্ট্রের পুনা ও আহম্মদনগর জেলায় কুনবি সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকরা সাউকার ( মহাজন ) বা বনিদের ( গ্রামীণ মহাজন ) হাতে সবথেকে বেশি শােষিত ও অত্যাচারিত হয় ।
  • পুনা জেলার অন্তর্গত সিরুর তালুকে কারদে নামক গ্রামে ১৮৭৪ – এর ডিসেম্বরে কালুরাম নামক জনৈক মহাজন বাবাসাহেব দেশমুখ নামক এক ঋণগ্রস্ত কৃষকের বাড়ি – জমিসহ সব সম্পত্তি নিলামে মাত্র ১৫০ টাকায় কিনে নিলে গ্রামের অধিবাসীরা কেংলিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘটায় ।
  • ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে পুনা জেলার সুপা গ্রামে উন্মত্ত জনতা গুজরাটি মহাজনদের ঘরবাড়ি, দোকান, গদি লুট করে।
  • পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়, এবং প্রায় ৬০০০ কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড দেওয়া হয়।
  • ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ কমিশন নিয়ােগ করা হয়। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তি করে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য কৃষি ত্রাণ আইন ( Deccan Agriculturist Relief Act ) প্রবর্তিত হয় ।



মােপলা বিদ্রোহ (১৯২১) :

  • কেরলের মালাবার অঞ্চলে মুসলমান মােপলা কৃষকরা হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মােপলা বিদ্রোহ করে।
  • ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত এই বিদ্রোহে কৃষকদের মূল দাবি ছিল সুনিশ্চিত প্রজাস্বত্ব আইন ও তার নবীকরণ এবং জমিদারদের শােষণ থেকে মুক্তি ।
  • ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পুলিশেরা তিরুরঙ্গদি মসজিদে অস্ত্রখোজার নামে তল্লাশি চালালে পুলিশ, থানা, জমিদার ও মহাজনদের বাড়ি আক্রমণ করে।
  • মালাবারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কনােলির বাংলাে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করা হয় ।
  • এরনাথ ও অলুভানাথ অঞ্চল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
  • মােপলারা বিভিন্ন স্থানে রিপাবলিক গঠন করে।
  • মােপলা বিদ্রোহের নেতারা ছিলেন কানহামমত গাজী, কলথিনগল মহম্মদ, আলি মুশালিয়ার, সিথি কয়ামঙ্গল ইত্যাদি।
  • ব্রিটিশরা ২৩৩৭ বিদ্রোহীকে হত্যা করে, ১৬৫০ জনকে আহত করে এবং ৪৫০০০ বেশি লােককে বন্দী করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ৬৬ জনকে পুনুরের রেলের ওয়াগনের মধ্যে বন্দী রাখা হয় এবং শ্বাসকষ্টে তারা মারা যান।



বরদোলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮) :

  • গুজরাটের বরদোলী জেলায় ২২%ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি হলে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নাে রেভিনিউ ক্যাম্পেন শুরু করেন।
  • ব্রিটিশরা সেই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। সরকার একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়ােগ করেন। এই কমিটির সুপারিশে ভূমিরাজস্ব কমানাে হয়। এই সত্যাগ্রহের অনুসন্ধানের জন্য সরকার ম্যাক্সওয়েল ব্লুমফিল্ডকে নিয়ােগ করেন।
  • কানভার্মি মেহেতা ও কল্যানজি মেহেতা, দুই ভাই এই আন্দোলন শুরুর জন্য সর্দার প্যাটেলকে অনুরােধ করেন। তারা জমিদার যুবক মণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেন।


কোল বিদ্রোহ (১৮২০-১৮৩২) :

  • বুদ্ধু ভগত , জোয়া ভগত , ঝিন্দরাই মানকি ও সুই মুন্ডা প্রমুখের নেতৃত্বে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলায় কোম্পানির খাজনা বৃদ্ধি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোলরা যে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিল ইতিহাসে তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত ।
  • বিহারের অন্তর্গত ছােটনাগপুরে ওঁরাও, মুণ্ডা, হাে ইত্যাদি কোল সম্প্রদায়ের লােকেরা বাস করতেন।
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর কোল উপজাতির উপর জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর অত্যাচার বৃদ্ধি পেলে কোলরা বিদ্রোহের পথে যায়।
  • ১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দে পােহাটের জমিদার ও ইংরেজ সেনাপতি বুওসেজ-এর বিরুদ্ধে চাইবাসার যুদ্ধে কোলরা পরাস্ত হয়।
  • ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে কোলরা পুনরায় বিদ্রোহ ঘােষণা করে।
  • মানভূম, সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, ছােটনাগপুর ইত্যাদি স্থান এই বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল।
  • কোলরা বহিরাগতদের ‘দিকু’বলত।
  • লর্ড বেন্টিঙ্কের নির্দেশে ক্যাপ্টেন উইলকিনসন কোলদের পরাস্ত করেন। কোলদের শান্ত করতে সরকার দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করেন।
  • কোল বিদ্রাহের বিস্তৃত বিবরণ জানা যায় জগদীশ চন্দ্র ঝা এর লেখা ‘দ্য কোল রেবেলিয়ান’ গ্রন্থ থেকে।



মুণ্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০) :

  • মুণ্ডা নেতা বীরসামুণ্ডা ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
  • মুণ্ডা কথার অর্থ গ্রামপ্রধান।
  • ছােটনাগপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুণ্ডা আদিবাসীরা বাস করত।
  • আদিবাসী মুন্ডাদের কৃষিব্যবস্থার চিরাচরিত ‘খুঁৎকাঠি প্রথা ’ অর্থাৎ ‘ জমির যৌথ মালিকানা ’ব্যবস্থাকে ব্রিটিশ সরকার ভেঙে ফেলে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে । এছাড়া জমি থেকে মুন্ডা উপজাতিকে উৎখাত, বিভিন্ন কর আরোপ, অত্যাচার প্রভৃতি কারনে মুন্ডা বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে।
  • শৈলরাকার পাহাড়ে এক যুদ্ধে মুণ্ডা সেনাপতি গয়ামুণ্ডা মারা যান।
  • মুণ্ডা বিদ্রোহ উলগুলান বা বিপজ্জনক নামে পরিচিত।
  • ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন রাঁচির জেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে কলেরায় বীরসামুণ্ডার মৃত্যু হয়।
  • মুন্ডা বিদ্রোহের তীব্রতায় ব্রিটিশ বাধ্য হয় মুন্ডাদের অভাব – অভিযােগ শুনে সেগুলির সমাধান করতে এই লক্ষ্যে পাস হয় ছােটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন ( ১৯০৮ ) ( Chotonagpur Tenancy Act. 1908 ) ।



মাহার আন্দোলন :

  • ড.বি.আর. আম্বেদকর মহারাষ্ট্রে মাহার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
  • এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সর্বসাধারণের জন্য জলের কল ব্যবহার, মন্দির প্রবেশ, এবং আইন সভায় মাহারদের প্রতিনিধিত্ব।
  • ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে মাহাররা মনুস্মৃতি পুড়িয়ে এই আন্দোলনকে আরাে জনপ্রিয় করেন।
  • আন্দোলনের ফলে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাহার সম্প্রদায় নাসিকের বিখ্যাত কালরাম মন্দিরে প্রবেশের সুযােগ পায়।
  • মাহার আন্দোলনকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নেতৃত্ব দেন গােপাল বাবা অলঙ্কার। তিনি সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরিতে মাহারদের বেশি পদের দাবি করেন।


  • ফরাজি/ফরায়েজি আন্দোলন :

    • ওয়াহাবি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হাজী শরীয়তুল্লাহ বাংলার মুসলমান সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন।
    • ‘ফরাজি’ শব্দটি আরবি শব্দ ফরাজ থেকে এসেছে । ফরাজি শব্দের অর্থ হল ‘ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য ’ বা ইসলাম ধর্মের আদর্শে বিশ্বাস ।
    • ফরাজী আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি কৃষকদের আন্দোলনে রূপ লাভ করে।
    • ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরিয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র মহম্মদ মহসীন বা দুদুমিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। দুদুমিঞা ঘােষণা করেন — জমির মালিক হলেন ঈশ্বর , যারা জমি চাষ করছে জমি তাদেরই ।
    • ১৮৪৮ সালে দুদুমিঞা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ও বিচারে তার আর্থিক জরিমানা সহ কারাদণ্ড হয়। ১৮৬০ মতাম্বরে ১৮৬২ সালে ঢাকায় দুদুমিঞা মারা যান।
    • দুদুমিঞা বাহাদুরপুর গ্রামে মারা গেলে তার দ্বিতীয় পুত্র নােয়ামিঞা ( আসল নাম আবদুল গফুর ) আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ।
    • নােয়ামিঞার মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সৈয়দ আল – দিন – আহ‌্মদ ফরাজি আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিলেও এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ।
    • ক্রমশ ফরিদপুর ও ঢাকা থেকে ফরাজি আন্দোলন খুলনা , ময়মনসিংহ , কুমিল্লা , যশােহরসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে ।
    • ফরাজিরা ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত পাঁচচরে অবস্থিত ইংরেজ নীলকর ডানলপের কুঠি আগুনে পুড়িয়ে দেয় ও গােমস্তা কালিপ্রসাদকে খুন করে ।



    কুকা আন্দোলন :

    • উনবিংশ শতকে পাঞ্জাব কেন্দ্রিক কুকা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ভগত জহরমল। শিয়ান সাহিব নামে তিনি পরিচিত ছিলেন।
    • জহরমলের শিষ্য বালাক সিং এরপর কুকা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
    • রাম সিং কুকা আন্দোলনকে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
    • রাম সিংকে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয় ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।



    চুয়াড় বিদ্রোহ:

    • ১৭৬৭-৯৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বাঁকড়া, মেদিনীপুর ও ধানভূম অঞ্চলে চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।
    • ১৭৬৭-১৭৬৯, ১৭৮৩-১৭৮৪ এবং ১৭৯৮-১৭৯৯ সালে তিনটি পর্যায়ে এই প্রতিরােধ সংঘটিত হয়েছিল।
    • চুয়াড়দের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ১৭৯৮-১৭৯৯ খ্রিঃ ।
    • চুয়াড়দের সর্দাররা পাইক নামে পরিচিত ছিলেন। পাইকরা বহু শতাব্দী ধরে শুল্কহীন জমি ভােগ করে আসছিলেন। বিনিময়ে তার শাসককে প্রয়ােজনের সময়ে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেন। কৃষকরা পাইকদের এই শুল্কহীন জমিতে চাষাবাদ করতেন।
    • কোম্পানি প্রবর্তিত নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা এইসব নিম্নবর্গের মানুষদের রেহাই দেয়নি। একসময় তারা নিরুপায় হয়ে কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।
    • ধলভূমের রাজা জগন্নাথ ধল ১৭৭০ খ্রীঃ বিদ্রোহ করেন এবং এই সময়ে চুয়াড়রা কোম্পানীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবার গড়ে তোলে।
    • কোম্পানির রাজস্বনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জমিদাররাও অনেকে এই বিদ্রোহে সামিল হয়। বাঁকুড়ার রাইপুর অঞ্চলের জমিদার দুর্জন সিংহ এই চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
    • ১৭৯৯ খ্রীঃ ফেব্রুয়ারী মাস থেকে চুয়াড়দের অত্যাচারের স্পষ্ট বিবরণ তুলে ধরে মেদিনীপুরের কালেক্টর জে. ইমহফ (J. Imhoff) অসংখ্য চিঠি ফোর্ট উইলিয়াম পাঠান।
    • গ্রাম পােড়ানাে হয়েছিল, খাদ্যশস্য শস্য লুট করা হয়েছিল এবং যারা চুয়াড়দের বিরুদ্ধে কোম্পানীর পক্ষে কথা বলেছিল তাদের তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হয়েছিল।
    • বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করে এবং নিষ্ঠুর দমননীতির দ্বারা কোম্পানীর সরকার কোনক্রমে চুয়াড়দের দমন করতে সক্ষম হয়।



    রংপুর বিদ্রোহ:

    • দেবী সিংহ নায়েব নাজিম রেজা খানকে 16 লক্ষ টাকা দিয়ে পূর্ণিয়া (বিহার) জেলা থেকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করেছিলেন ।
    • সর্বাধিক পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারের ফলে জনগণ পূর্ণিয়া ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলে তিনি হেস্টিংসের দ্বারা বরখান্ত হন।
    • কিন্তু দেবী সিংহ হেস্টিংসকে অর্থ দিয়ে বশীভূত করেন এবং প্রাদেশিক রেভিনিউ বাের্ডের সদস্য হন।
    • ১৭৮০ খ্রীঃ তিনি মুর্শিদাবাদের একজন ছােট রাজা রাধানাথ সিংহের দেওয়ান নিযুক্ত হন।
    • ১৭৮১ খ্রীঃ দেবী সিংহ রংপুর এবং দিনাজপুরের প্রতিবেশী পরগণার ইজারা ক্রয় করেন।
    • রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দদেশ্যে পূর্ণিয়ার ন্যায় রংপুর এবং দিনাজপুরেও তিনি অত্যাচার শুরু করলে রংপুরের বিভিন্ন গ্রামের কৃষক সম্প্রদায় ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ই জানুয়ারী টেপা (Tapa) গ্রামে সংঘবদ্ধ হন এবং দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
    • বিদ্রোহীর নুরুলউদ্দিনকে তাদের নেতা এবং অপর একজন কৃষক দয়ারাম শীলকে তার সহযােগী হিসাবে নিযুক্ত করে।
    • নুরুলউদ্দিন স্থানীয় কৃষকদের উপর এক নিষেধাজ্ঞা জারী করে দেৰী সিংহকে খাজনা প্রদান করতে নিষেধ করেন।
    • পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন 'নবাব' উপাধিধারী দির্জেনারায়ণ
    • রংপুর কৃষক বিদ্রোহ ঝড়ের বেগে দিনাজপুর ও কুচবিহারে ছড়িয়ে পড়েছিল।
    • হাজার হাজার সশস্ত্র কৃষক দেবীসিংহের প্রাসাদ আক্রমণ করে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছিল।
    • স্থানীয় জমিদাররা অনেকেই সেদিন বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ হারান।
    • রংপুরের কালেক্টর গুডল্যাড বেশ কয়েক কোম্পানি সেনা নিয়ে বিদ্রোহী চাষীদের মােকাবিলায় অবতীর্ণ হলে এই অভ্যুত্থান সাম্রাজ্যবাদবিরােধী লড়াইয়ে পরিণত হল।
    • এই যুদ্ধে রংপুর বিদ্রোহের নেতা নুরুলউদ্দিন গুরুতরভাবে আহত হন। দয়ারাম শীলকে হত্যা করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীরা পাটগ্রামের যুদ্ধে পরাজিত হন।
    • কয়েক শত বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়েছিল এবং কয়েক শত বিদ্রোহীকে ফাসিতে ঝােলানাে হয়েছিল।
    • এই বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানের জন্য পিটারসনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল। কমিশনের রিপাের্টে এই হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য দেবী সিংহকে দায়ী করা হয়েছিল।
    • কিন্তু হেস্টিংস দেবী সিংহের পক্ষে ছিলেন এবং তিনি অপর একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়ােগ করে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে আনা অভিযােগগুলি খণ্ডন করেছিলেন।



    সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ:

    • ১৭৬৯ সালে নোয়াখালি জেলার দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের বিদ্রোহ সন্দীপ বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
    • বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত নোয়াখালি জেলার অন্তর্গত কয়েকটি দ্বীপের সমষ্টি হল সন্দীপ অঞ্চল । অনেকের মতে শস্যপ্রাচুর্যের জন্যই এই দ্বীপটির প্রথমে নাম ছিল স্বর্ণদ্বীপ , যা পরে সন্দীপ নাম ধারণ করেছে ।
    • সন্দ্বীপের বেশির ভাগ অধিবাসী ছিল মুসলমান।
    • গভর্নর ভেরেলেস্ট সাহেব গােকুল ঘােষাল নামক এক লবণ ব্যবসায়ীকে জমি জরিপের মাধ্যমে রাজস্বের হার নির্ধারণের কাজে সন্দীপে পাঠিয়েছিল ।
    • তিনি বিষ্ণুচরণ বসু নামক এক বিশ্বস্ত কর্মচারীর নামে রেজিস্ট্রি করে এক কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে আহাদ‌্দারির দায়িত্ব নেন ।
    • শুরু হয় সন্দীপ অঞ্চল জুড়ে গােকুল ঘােষালের লুণ্ঠন , যাতে অতিষ্ঠ হয়ে সন্দীপবাসী বিদ্রোহের রাস্তায় যায় ।
    • ফলে সন্দ্বীপের জনগণ ও জমিদাররা ১৭৬৯ সালে আবু তোরাপের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে।
    • গােকুল ঘােষালের প্ররােচনায় ব্রিটিশ গভর্নর সন্দীপ বিদ্রোহের নেতা আবু তােরাপকে দমন করার জন্য ক্যাপটেন নলিকিনকে পাঠান ।
    • ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সেখানে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহীদের দমন করেন , অবসান ঘটে সন্দীপ বিদ্রোহের ।
    • ১৭৭২ সালে ইংরাজ কোম্পানি আহাদদারের পদ বিলুপ্ত করে একজন আমিন নিয়োগ করেন।
    • মুর্শিদাবাদের রেভিনিউ বোর্ড ১৭৭৮ সালে ডানকান নামে একজন কর্মচারীকে তদন্তের জন্য পাঠায়।
    • ডানকান গোকুল ঘোষালের কুকীর্তির কথা কোম্পানিকে জানালে কোম্পানি আবু তোরাপের পুত্র আলী রাজা ছাড়া সব জমিদারি জমিদারদের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
    • আবু তোরাপের জমিদারী ভবানীচরণ দাসের নামে গোকুল ঘোষাল ভোগ করতে থাকে।
    • গোকুল ঘোষাল ও ভবানীচরণ দাসের অত্যাচারে পুনরায় ১৮১৯ সালে সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়।
    • ১৯৫৫ সালে সন্দ্বীপের জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়।



    বারাণসী বিদ্রোহ

    • কৃষি , শিল্প ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধ জায়গির ছিল বিহার প্রদেশের অন্তর্গত বারাণসী ।
    • অযােধ্যার নবাবের অধীনস্থ এই জায়গিরটির জায়গিরদার ছিলেন বলবন্ত সিং ।
    • ব্রিটিশ বলবন্ত সিংহের পুত্র চৈত্য সিংহকে বাংসরিক ২২ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে বারাণসীর রাজপদে বসায় ।
    • গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস চৈত্য সিংহের কাছ থেকে তিন ব্যাটেলিয়ন সৈন্যের বাৎসরিক খরচ চালানাের জন্য অতিরিক্ত ৫০ হাজার পাউন্ড ( ৫ লক্ষ টাকা ) দাবি করেন ।
    • চৈত্য সিংহ এই বিশাল পরিমাণ কর আদায় করতে গিয়ে কৃষক প্রজাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে ।
    • সারাবছর ধরে কৃষকেরা খেতে যে ফসল ফলায় তা সবই খাজনা দিতে গিয়ে হাতছাড়া হওয়ায় প্রজারা ক্ষুদ্ধ হয়ে এই অঞ্চলে যে বিদ্রোহ ঘােষণা করে তা বারাণসী বিদ্রোহ নামে পরিচিত ।
    • ব্রিটিশের অর্থক্ষুধা মেটাতে ব্যর্থ হলে হেস্টিংস চৈত্য সিংহকে তাঁর নিজের প্রাসাদে বন্দি করে রাখে ।
    • এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রজারা বারাণসীতে আসতে শুরু করে । সশস্ত্র জনতা ইংরেজ পক্ষের সব সৈন্যকে হত্যা করে ।
    • হেস্টিংস গােপনে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠানাের নির্দেশ দেন । হেস্টিংসের নির্দেশ মেনে বাংলা , চুনার ও লখনউ থেকে ক্যাপ্টেন মেফেয়ারের নেতৃত্বে , মেজর মর্গ্যানের নেতৃত্বে , মেজর পপহামের নেতৃত্বে পরপর তিনটি বিশাল সেনাবাহিনী বারাণসী বিদ্রোহ দমন করার জন্য এগিয়ে আসে । ক্যাপটেন মেফেয়ারের নেতৃত্বে বিশাল ব্রিটিশবাহিনী লতিফগড় দূর্গের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করে ( ১৭৮১ খ্রি. ২০ সেপ্টেম্বর ) ।